প্রতিষ্ঠাতার জীবনগাঁথা

প্রতিষ্ঠাতার জীবনগাঁথা

মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন (বর্তমান প্রধান শিক্ষক)

গ্রাম-চর সেকান্দর, ০১নং ওয়ার্ড, ০৯নং চর আলগী ইউনিয়ন, রামগতি, নোয়াখালী(তৎকালীন)। একজন ইউপি সদস্য- লম্বা, সুঠামদেহী, শ্যামবর্ণ, সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল মুখমন্ডল। নাম তাঁর মোঃ সফিক উদ্দিন, পিতা- মুন্সী মিয়া। এলাকার সমস্যা সমাধানে তাঁর ফলপ্রসু ও কার্যকরী পদক্ষেপে ছিল মুন্সীয়ানা। মোঃ সফিক উদ্দিনের সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। খুব সহজেই অপরকে আপন করে নিয়ে উদ্দিষ্ট কাজকে সহজেই সমাধান করতে পারতেন। জনসেবা করার প্রকৃত আকাঙ্খা থেকেই এসকল গুণাবলী তাঁহার মধ্যে দেখা নিয়েছিল। শুধু নিজ এলাকাই নয়, অন্য এলাকায়ও তিনি সমাদৃত ছিলেন।

১৯৭১ সালে বড় ভাই হাফিজ উদ্দিনসহ তিনি মু্ক্তিযু্দ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন বিপদগ্রস্থ পরিবারগুলোর সহযোগিতায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। অনেক আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দান করে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি। একদিন গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা সফিক মেম্বারের বাড়ী থেকে খাওয়া দাওয়া করে চর আলেকজান্ডার রাজাকারের ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছিলেন। পরদিন সকালবেলায় রাজাকারদের একটি বাহিনী সফিক মেম্বারের বাড়ী আক্রমন করে তাঁর ঘরদুয়ার পুড়িয়ে দেয় এবং তাঁর ছোটভাই নূর মোহাম্মদকে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে মোঃ সফিক উদ্দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৭৩/১৯৭৪ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি ইউনিয়নের ভাইস চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড মেম্বার দুইটি পদেই একসাথে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন। আঞ্চলিকতার মারপ্যাচে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান পদে সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে গেলেও ওয়ার্ড মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত ৩ জন সদস্যের মধ্যে সর্বাধিক ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। চর সেকান্দর, চর নেয়ামত ও চর হাসান হোসেন গ্রামের বিশাল এলাকার মধ্যে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় এই এলাকায় একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে মোঃ সফিক উদ্দিন ১.৬১ একর ভূমি দান করে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাচিত হন এবং এলাকাবাসী স্কুলটির নামকরণ করেন চর সেকান্দর সফিক একাডেমী।বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির জন্য তিনি বাড়ি বাড়ি হেঁটে ধান, গাছ ও টাকা সংগ্রহ করেন এবং এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর ১.৬১ একর ভূমি দানে উৎসাহিত হয়েই অন্যান্য ১৫জন এলাকাবাসী উল্লেখযোগ্য পরিমান ভূমি দানে উৎসাহিত হন। ভূমি দান ও কায়িক শ্রম ছাড়াও তিনি বিদ্যালয়কে অনেকবার আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তাঁর এই ফলপ্রসু পদক্ষেপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন কর্মপরিচালনায় কিছু স্বার্থান্বেষী চোর, ডাকাত, বর্বর ও সুবিধাভোগী ক্ষমতা লোভী লোকের ক্রোধানলে পতিত হন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৩ই এপ্রিল বিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। বিদ্যালয়ের নিজস্ব গৃহ না থাকায় চর সেকান্দর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অনুষ্ঠন রাত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছিল। হ্যাজাক লােইট জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান চালানো হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সেই লঅইটের আলোতে পথ দেখে চর আলগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ (খাঁন সাহেব) ও মোঃ সফিক উদ্দিন কয়েকজন লোককে সাথে করে সাহাপাড়া যাওয়ার রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলে। মাঝ মাঠ বরাবর পৌঁছানোর পর পূর্বেই ওৎপেতে থাকা একদল দুষ্কৃতিকারী দা-ছেনি নিয়ে মোঃ সফিক উদ্দিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুস্কৃতিকারীরা তাঁকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এভাবে চর সেকান্দর সফিক একাডেমীর ভাগ্যাকাশ থেকে একটি নক্ষত্র খসে পড়ে। বিদ্যালয়ের ৫০ বছরের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনা। প্রতিষ্ঠাতা মোঃ সফিক উদ্দিনের চির বিদায়ের শোককে শক্তিতে পরিণত করে এলাকাবাসী বিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পরবর্তিতে মোঃ সফিক উদ্দিনের ভাই মোঃ সাইফ উল্যা ও মোঃ হাফিজ উদ্দিন বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য যথেষ্ট অবদান রাখেন। তৎপরবর্তি প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে মোঃ সফিক উদ্দিনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তাঁরিই ছেলে নিজাম উদ্দিন স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। যিনি দীর্ঘ্য ২ যুগেরও বেশি সময় এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন।

সেই ১৯৭৫ সাল থেকে তাঁর দুঃসহ স্মৃতিকে বহন করে সফিক একাডেমী ৫০ বছরের মাইলফলক অতিক্রম করে সম্মুখে এগিয়ে চলেছে। দিনে দিনে প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে ও বর্হিবিশ্বে সফিক উদ্দিনের রেখে যাওয়া একাডেমীর পতাকা সমুন্নত রেখে জানান দিচ্ছে- বলবীর, চির উন্নত মম শির। সত্যিকার অর্থে সফিক উদ্দিন পরাজিত হননি, তাঁর মৃত্যু ঘটেনি। পরাজিত হয়েছে তারাই, যারা হত্যার মত এমন ঘৃণ্য কাজ করতে পারে। সভ্য সমাজে তাদেরই মৃত্যু ঘটেছে। মোঃ সফিক উদ্দিন মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছে। যুগ যুগ ধরে তা থাকবে চির অম্লান ও চিরস্থায়ী হয়ে। কেননা- কীর্তিমানের মৃত্যু কখনোই হয় না, হবেও না।